Type Here to Get Search Results !

আমার স্বপ্নের গ্রাম 'বড়উঠান'



সাজ্জাদ খান:-
"আমি একবার দেখি-বার বার দেখি -দেখি বাংলার মুখ "
অন্তরে বড়উঠানের যে ছবি আমি তুলে রেখেছি,সেই ছবি (যতটুকু মনে আছে) আজ হুবহু এঁকে দিলাম ফেইসবুকের পাতায় যাতে ,হারিয়ে না যায়।নতুন প্রজন্ম যাতে জানতে পারে আমাদের গ্রাম কেমন ছিলো।ছিলোনা কোনো রাজনৈতিক উগ্রতা,ছিলো প্রত‍্যেকের প্রতি প্রত‍্যেকের সন্মান,ছিলোনা শহুরে মেকি ভাব আর অতিরিক্ত অর্থ লোভী মানুষ।ছিল সবুজ পাহাড় ঘেরা শান্ত,চোখ আর মন জুড়ানো প্রকৃতির লীলা ক্ষেএ,শহুরে কোলাহল থেকে অনতি দূরে স্বপ্নের মত শান্তির এক গ্রাম।)

"জোয়ার আইস‍্যে ছলন রণা হই "এই ছিল মরহুম খুইল‍্যা মাঝির কথা।আমি তখন প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ে পড়ি।সকাল নয়টায় শহর থেকে গ্রামের উদ্দ‍েশ‍্যে রওয়ানা হতাম।খুইল‍্যা মাঝির ছই ওয়ালা নৌকা আসতো চাক্তাই খালে।তখন স্বচ্ছ খালের পানি।নদী পারা পারের জন‍্য নৌকাই ছিল প্রধান বাহন।যন্ত্রচালিত লন্চ তখন চালু হয়নি।পাঁচ ঘন্টার মত জোয়ার থাকে অর্থাৎ সকাল ৯টায় শুরু হলে দুপুর ২টা পর্যন্ত।২টার পর থেকে ভাটা শুরু।রওয়ানা দিতে দিতে দশটার মত হত।খালে বড় বড় মালবাহী নৌকা গুলির ফাঁকে ফাঁকে আমাদের নৌকা কর্ণফূলী নদীর বুকে এসে পড়ত।কর্ণফূলী তখন দূষন মুক্ত প্রমও উচ্ছল এক নদী।ধীরে ধীরে এগোতে থাকে নৌকা সাথে শ্লথ গতিতে বদলাতে থাকে দৃশ‍্যপট।ছোট ছোট কিছু তেলের জাহাজ ভাসছে।তখন শিকলবাহা বিদ‍্যূত কেন্দ্র হয়নি।নদীর অন‍্য পাড়ে সাড়ি সাড়ি গাছ আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে কিছু বাড়ি দেখা যেত।নৌকা আস্তে আস্তে প্রবেশ করত শিকলবাহা খালে বা মুরারী খাল।খালের দুপাশে গাছ গাছালিতে সবুজের সমারোহ।কালার পোল তখন মানুষ চলাচল উপযোগী।ভেল্লা পাড়া,পেশকার হাট,দৌলতপুর টেক এরপর বামনের পোল আমাদের গন্তব‍্য।নৌকা থেকে নামার সাথে সাথে মাটির কেমন একটা সোঁদা গন্ধ নাকে লাগত।সকাল দশটায় রওয়ানা হলে বামনের পোল(বঁনারো ফোল) আসতে প্রায়  তিন ঘন্টা লাগত।ভাটায় আসলে চার সাড়ে চার ঘন্টা লাগত।

এরপর গ্রামের মেঠো পথ।বইতে যেমন পড়েছি।দুপাশে সবুজ ধান ক্ষেত।বাতাসে ধানের শীষ হেলে দুলে যেন বলছে এসো হারিয়ে যাও সবুজের মাঝে।
রিক্সা আসতো আমাদের নেওয়ার জন‍্য।প্রায় ফাঁকা মেঠো পথে রিক্সা চলতো সেই পথের নাম হল মিঞার রাস্তা(আনোয়ার আলী খান সড়ক)সেখান থেকে বড় রাস্তায়,যা কিনা কর্ণফূলীর তীর থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত চলে গেছে।মাঝে মাঝে ভাড়ায় চলা পুরোনো জীপ গাড়ি চলে। আর চলত কাঠের চাকার গরুর গাড়ি।মাটি দিয়ে  বাধানো বড় রাস্তা।জীপ চলার কারণে শুস্ক মৌসুমে প্রচুর ধুলোবালি উড়তো।
বড় রাস্তায় উঠলেই বড়উঠান রাস্তার মাথা।অল্প দক্ষিণে গেলেই মিঞার হাট।হাটের পূর্বদিকে ছিল মরহুম মোহাব্বত আলীর চায়ের দোকান,একপাশে ছিল মরহুম আহম্মদ হোসেনের চায়ের দোকান,তারপর মরহুম নুরুল ইসলামের পান সিগারেটের দোকান,মরহুম সেকান্দরের মুদির দোকান,হাটের মাঝখানে ছিল মরহুম গফুর খলিফার কাপড় সেলাইর দোকান,উনি আবার আমাদের বাড়ির মসজিদের ইমাম ছিলেন।সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল হাটের পশ্চিম পাশে মরহুম আহম্মদ মিঞার কাপড়ের দোকান।আয়না দেওয়া আলমারিতে থরে থরে সাজানো কাপড়।আরও ছিল চুলকাটার সেলুন।হাট ফেলে পশ্চিম দিকে অল্প গেলেই কল ঘর।ধান চুড়ানো হত।কল ঘরের ঠিক উল্টো দিকে বিশ এিশ ফূট উঁচু এক বিশাল গাছ সকলে বলত হড়ি গাছ।কলঘর থেকে সামান‍্য দক্ষিণে আমার বাড়ি।সামনে এক একরের  পুকুর উওরে একটা পশ্চিমে দুটো মোট তিনটি একই ধরনের পাকা জমিদারি আমলের ঘাট।শান্ত স্বচ্ছ পানি।পুকুরের পশ্চিম দক্ষিন কোণে কারু কাজ করা তিন গম্বুজের মসজিদ।পশ্চিমের উওর দক্ষিণে লম্বা মাটির কাজ করা কাচারি ঘর।কাচারি ঘরের মাঝখান  দিয়ে মানুষ চলাচলের পথ।গ্রামের মানুষ এই পথটাকে বলত পেটকাটা।এই  কাচারি ঘর পেরিয়ে একটা প্রায় ১১০/১২০বছরের পূরাতন পরিত‍্যক্ত দ্বিতল বাড়ি।যাতে একসময়ে কয়েক  জন জমিদার বসবাস করেছিলেন।এই বাড়ির পরেই আমাদের বতর্মান বসবাস যোগ‍্য আবাস।বাড়ির উওর পাশে ধানের গোলা ঘর।বাড়ির সামনে একটা মাটির ঘর।সকলেই বলে ঢেকি ঘর।বাড়ির চর্তূদিকে বেশ কিছু ঝাকরা ঝাকরা গাছ।আম, লিচু, ছেবেটা,কামরাঙ্গা,বেল,বওা,সাদা জাম,কুল,খেজুর সহ আরও অন‍্যান‍্য কিছু গাছ।বাড়ির দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সীমানা গড় ও ভেতরে একটা গভীর কিন্তু ছোট পুকুর।

গ্রামের ভোর, সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।সেই প্রাকৃতিক  সৌন্দর্যের সঠিক বর্ণনা দেওয়া কঠিন।রবির প্রথম কিরণচ্ছটা যখন সবুজ গ্রামের উপর ছড়িয়ে পড়ে মনে হয় স্রষ্টা যেন সবুজ রঙের উপর গলিত সোনার রঙের পোচ দিয়েছেন।গ্রামের ভোর যে দেখেনি সে মনে হয় প্রকৃতির সৌন্দর্যের অনেক কিছুই দেখেনি।হেসে উঠেছে প্রকৃতি,হেসে উঠেছে ধরা।পাখিরা নীড় ছাড়ছে প্রচন্ড কলতানে।তখন প্রায় বাড়িতেই মুরগী মোরগ,দুধের গরু পালা হত।কাক ডাকা ভোর বললেও সাথে মোরগ ডাকা ভোর বললেও ভুল হবেনা।সেই ভোরের আলোয় দেখতাম কাঁধে হাল নিয়ে এক জোড়া গরু "ব" "ব" বলে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে মরহুম ছউন্না  ধান ফলানো জমিতে।সাথে রয়েছে হাতে তৈরী হোক্কা আর হোক্কায় আগুন দেওয়ার জন‍্য শুকনো খড়।
১০টা /১১টার দিকে যে বা যারা হাল চাষ করছে ওদের জন‍্য ভাত নিয়ে যাওয়া হত।এটাই ছিলো অলিখিত নিয়ম।
সকালের সোনা রোদে ঝলমল করত বাড়ির আঙ্গিনা।মনের মাঝে কেমন যেন আনন্দ নেচে উঠত।সকালের প্রাতঃরাশে থাকতো বেশিভাগ নাম না জানা পিঠা।
আমার বাড়ির গাছে ঘুঘু,দোয়েল,ময়না (কথা বলা ময়না নয়),ফিঙ্গে,মাছ রাঙ্গা,চড়ুই আরও কয়েক রকম পাখি এসে ভীড় করত। বাড়ির  মসজিদের পূর্ব দক্ষিন কোণে একটা গাছ ছিলো, ঐ গাছে অনেক টিয়া পাখি বসত। ধান ক্ষেতে সাদা বক দেখতাম,সোনালী ডানার চিল  উপর থেকে Fighter Jet এর মত নেমে এসে ছোঁ মেরে মুহূর্তেই মাছ বা ছোট কোনো পাখি অথবা মুরগির বাচ্চা বা সাপ ধরে নিয়ে উড়ে যেত।ভয় পেতাম শকুনকে।বিশাল ছিলো শকুনের দেহ,ভয়ঙকর মুখ।কোনো মরা জীব জন্তু খোলা জায়গায় পড়ে থাকলে ঘুরে ঘুরে  নেমে আসত।

নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়তাম গ্রামের মেঠো পথে।শহরে ছিলো ছেলে ধরার ভয়ে বাইরে যাওয়ায় কড়াকড়ি।এখানে ছিলাম মুক্ত বিহঙ্গ। অনেক সময় হাতে নিতাম বাঁশ দিয়ে তৈরী আঁছার গুলার  বন্দুক সঙ্গী আবুল হাশেম (বর্তমানে ITTতে চাকুরীরত)আর জেবল হোসেন।কেহই বড় নই,সমবয়সী প্রায়।শহুরে ভাষায় আমি "বাসা"বললে ওরা হাসত বলত "বাড়ি"বলার জন‍্য।কি এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা! চারিদিকে সবুজ গাছ গাছালি  মাচা করে সব্জীর চাষ(শসা,লাউ)প্রায় প্রতিটি ছাদে মিষ্টি কুমড়া,চাল কুমড়ার লতানো গাছ।প্রায় বাড়ি গুলো ছিল মাটির আর ছনের ছাউনি।গ্রামের বাড়ির একটা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ত কাক ডাকা ভোরে নামাজের পর পর বাড়ির উঠান ঝাড়ু দেওয়া।সবার ঘর থাকত তকতকে ঝকঝকে।
সেন্ডেল পড়া পায়ে গাঁয়ের ধুলো মেখে পথ চলা।জায়গায় জায়গায় মাচায় কচি শষা ধরে আছে,ছিড়ে খেয়ে  মালিককে বললে বলতো একটা দুইটা নিয়ে কি হবে  বেশী করে নিতে।এমনও মনে আছে পাকা তাল গাছ থেকে পড়ে আছে কেউ নেয়নি।
হাটতে হাটতে ঘুরে বেড়ানো।গ্রামের পশ্চিমে মরহুম নজির আহমদের বাড়ি ফেলে পাহাড়ের নীচ পর্যন্ত যেতাম।পরে জেনেছি এই রাস্তাটার নাম আনোয়ার আলী খান সড়ক প্রকাশ মিঞার রাস্তা যেটা বামনের পোল থেকে শুরু,এই রাস্তা দিয়েই পাহাড়ের ভেতরে ভেতরে নদীর তীরে  যেত ,নৌকা করে নদী পার হয়ে শহরে  যেত মানুষ।একবার দুই পাহাড়ের মাঝখানে চলে যাওয়া রাস্তায় ঘুরতে গিয়ে খুউব বকা খাই।কারণ ঐ নির্জন পাহাড়ের  উপর মাঝে মধ‍্যে ডাকাতের আনাগোনা  ছিলো।
একবার বিকেলে খবর এলো ঐ পাহাড়ের উপর কিছু অচেনা লোক দেখা গেছে।পুরো গ্রাম ছড়িয়ে পড়লো যে ডাকাত আস্তানা গেরেছে ওখানে।তখন পটিয়া থানায় খবর পাঠানো এক দুরুহ কাজ।গ্রামের মানুষ নিজেরাই শেল বল্লম ধার দিয়ে পাহাড়ায় লেগে গেল।আমাদের একটা Double barrel বন্দুক ছিলো সেটা Loaded রাখা হত।রাতে মানুষের সেকি উওেজনা।এই বুঝি ডাকাত আসে।

মাঝে মাঝে ঘিরা পুকুরের পাশ দিয়ে চিকন একটা মেঠো পথ ফাজিল খাঁর হাট চলে গেছে,সেই পথে দৌলতপুর চলে যেতাম।

মহিলারা লুঙ্গির মত ফুল আঁকা বা অন‍্য কোনো নকশা করা থামি পড়ত।দিনের বেলা বেরুলে বোরকার সাথে ছাতিও ব‍্যবহার করত পর্দা হিসেবে।রিক্সায় মহিলা উঠলে শাড়ি বা বড় কাপড় পেঁচিয়ে রিক্সা ঢেকে দেওয়া হত।
এই গ্রাম ঘুরে বেড়ানোর  আরেক সঙ্গী ছিল আমার প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ের সহপাঠী মুরাদ।ডাকপাড়ার সম্ভ্রান্ত পাঠান  পরিবারের  সদস‍্য।মুরাদ আসলে আমি প্রচন্ড খুশি হতাম,কেননা স্কুলেও আমরা বন্ধু ছিলাম। ছবির মত সাজানো মাটির ঘর দেখতে কেমন জানি হাতে আঁকা ছবির মত  লাগত,প্রায় ঘরের সামনেই ছিলো মুরগির চারণ ক্ষেএ।সময় বিশেষে বাড়ির সামনে চাটাইয়ের উপর ধান শুকাতো।

গরু দিয়ে হাল চাষ করা দেখতে ভালোই লাগত।খুউব মজা পেতাম ধান ক্ষেতে মাছ ধরা। বর্ষাকালে কোনো সরু পানি নিষ্কাশনের নালা থাকলে,বেতের চাই বসানো হত মাছ ধরার জন‍্য।চাষীরা বা গ্রামের অন‍্যান‍্যরাও বেতের তৈরী জুঁই মাথায় দিয়ে বৃষ্টিতে বেরুতো।সরাসরি উপর থেকে দেখতে পেলে মনে হত বড়সড় পোকা হেটে চলেছে।
পুকুরে মাছ ধরার জন‍্য বড় জাল টানা হলে বড় বড় মাছ যখন লাফিয়ে লাফিয়ে জালের উপর দিয়ে চলে যেত,সে দৃশ‍্য ভোলার নয়।তখন আজকের নাইলেটিকা, কার্ফূ, গ্রাস কার্প এসব মাছ ছিলোনা।বেশি ছিলো রুই,কাতাল ও মৃগেল।প্রায় সময় পুকুরে ছোট বড়শি বাইতাম,ধরতো বেশী বাইলা মাছ।রাতের বেলা জ‍্যান্ত মাছ বড়শীতে লাগিয়ে ফেলে  রাখতাম শোল মাছ বা ঐ একই গোএের মাছ ধরার আশায়,সকালে দেখতে আসতাম কি ধরলো একবার মাছের জায়গায় সাপ ধরেছিল।পুকুরের পানি শুকিয়ে মাছ ধরার মজাই আলাদা। আমীর খাঁ দিঘীতে বহুবছর পর মাছ ধরার কারণে বড়শীতে ১৪/১৫ কেজির মাছও ধরা হত।

(আমার  দীর্ঘ এই লেখা ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ ইং এর মধ‍্যে কেমন ছিল আমার গ্রাম।বর্তমানে নগরায়ন আর শিল্পায়ানের যে প্রচন্ড গতি তাতে গ্রাম হারিয়ে যেতে বসেছে।হয়ত একসময় গ্রাম বলে আমাদের এখানে কিছুই থাকবেনা মুছে যাবে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় সবুজ গ্রাম।আমার গ্রামের সৌম‍্য শান্ত সবুজাভ রূপ আমি প্রচন্ড ভালোবাসি আর ভালোবাসি মানুষগুলোকে আর তাইতো ভালোবাসি মাতৃভূমিকে।)

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

বিজ্ঞাপন

জ।


https://vindaleue.xyz/2025241470119